প্রজন্ম গত ব্যবধান কি খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে না !
ইদানিং আমার কিছু বছর আগের কথা খুব মনে পড়ে। খুব বেশি না এই ধরা যাক আজ থেকে ৮-৯ বছর আগের সময়টা। আমিসহ আমার সমসাময়িক জেনারেশনটা সেসময় কেবল টিনএজ বয়সটা শেষ করেছি বা করব। আমাদের সেইসময়টা খুব অদ্ভুত সুন্দর ছিল। এইচএসসি শেষ করেছি মাত্র, ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেইসময়টায় আমাদের চোখে রনবীর কাপুর বা টম ক্রুজ ছিল বুয়েট, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় থাকা ভাইয়ারা, সোনম, কারিনাদের জায়গায় ছিল এইসব প্রতিষ্ঠানে সগৌরবে জায়গা করে নেয়া আপুরা। আমি এবং আমার আশেপাশের প্রায় সব ছেলেমেয়েরাই আমরা এমন ছিলাম। আমরা যে খুব ভয়াবহ মাত্রার আঁতেল ছিলাম তা কিন্তু না।
আমরা পড়াশোনার বাইরে আরও নানান কিছু করে বেড়াতাম। কলেজে কলেজে সাইন্স ফেয়ার, ডিবেট, কালচারাল কম্পিটিশন, ভাষা প্রতিযোগ, রচনা প্রতিযোগিতা, হবি ক্লাব, গান, নাচ আরও কত কি আমরা দলবেঁধে করতাম। আমাদের মধ্যে যে বা যারা ভাল ভাল স্কুল কলেজের প্রথম সারির ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম তাদের ভাব-ই ছিল আলাদা, আমাদের যাদের স্কলারশিপ ছিল তারা অন্যদের চোখে ছিল সমীহের; তারা ছিল বড়দের, শিক্ষকদের আদরের। এর সাথে সাথে এই ভাবের মাত্রা টুকটাক বেড়ে যেত যারা এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিজের জন্য স্কুল কলেজে পরিচিত ছিল তাদের। আমার এখনও মনে পড়ে পড়ালেখার সাথে সাথে যে মেয়েটা ভাল গাইত, নাচত, ভাল আবৃত্তি বা বিতর্ক করত আন্টিমহলে তার কদর ছিল আলাদা।
স্কুলে বা কলেজের রেজাল্ট,এনুয়াল ফাংশান বা মিলাদে আমরা খুব আগ্রহের সাথে যেতাম কারণ ওইদিন আমরা যেতাম খালি হাতে কিন্তু ফিরতাম একগাদা লাল-হলুদ-সবুজ ফিতায় মোড়া বই নিয়ে যেগুলো ছিল বিভিন্ন এক্টিভিটিজের কৃতিত্বপূর্ণ পুরষ্কার। আমাদের যাদের মায়েরা চাকরি-বাকরির জন্য এই দিনগুলোতে যেতে পারতেন না তারা ক্লাস টিচার, প্রিয় কোন আন্টি বা বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথেই দিনটা উদযাপন করত। আমাদের কলেজ জীবনটাও এমনই ছিল। এইচএসসির পর আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করতাম একটা ভাল সরকারি প্রতিষ্ঠানে মেধাতালিকায় থাকার। সৎ চেষ্টা যারা করত তারা কিন্তু রেজাল্টের দিন ঠিকই হাসত। আমাদের সময় ফেসবুক ছিল না, আমরা আলহামদুলিল্লাহ্ লিখে স্ট্যাটাস দিতে পারতাম না সত্যি কিন্তু চান্স পাওয়ার পর আমাদের কোচিং সেন্টার বা টিচারদের উচ্ছ্বাস ভরা শুভেচ্ছা আমরা ঠিকই পেতাম সে রেজাল্ট যত রাতেই দিক বা যত ভোরেই।
আজকাল প্রায়-ই শুনি ছেলেমেয়েদের ভাল রেজাল্ট, ভাল করার জন্য বাবা-মা’র তাগাদা দেয়াটাকে মানসিক চাপ, প্রতিযোগিতা মূলক মনোভাব হিসেবে ধরা হয় অথচ সেই ছেলেমেয়েই যখন ইন্সটাগ্রামে আসা প্রিয় নায়িকার এটায়ার, গেট আপ ফলো করতে করতে নাভিশ্বাস তুলে ফেলে সেটাকে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তো ধরা হয়-ই না বরং সেই মেয়েটা বন্ধু বা চারপাশের মহলে হয়ে ওঠে ডিভা!!!আমরা বছরে ঈদ আর ভাল রেজাল্ট ছাড়া সাধারণত জমকালো বা একটু দামী জামাকাপড় কিনতাম না। সেই জামাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পরতাম সংবর্ধনা বা কলেজের অনুষ্ঠানে। এর বাইরেও কিন্তু আমাদের জীবন ছিল। আমরা সিনেমা দেখতাম, আইফা, জি সিনে এওয়ার্ডস এর মত ফাংশন/ অনুষ্ঠানগুলো গিলতাম গোগ্রাসে, হুমায়ূন আহমেদের নাটক, ইত্যাদি, শাহরুখ, সালমান, ঐশ্বরিয়া, কাজল, রানী, ক্যাটরিনা, হৃত্বিক এইসব কিছুও আমাদের জীবনে ছিল। সেসময়ও এসব নায়িকারা প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরতেন, তাদের বিয়ে হত, বিয়ের সাজের ছবি আসত পেপারে- ইন্টারনেটে। কান, অস্কার এসবের লাল গালিচার ফ্যাশন সেন্স নিয়ে ফিচার হত। আমরা কিন্তু সবকিছু পড়তাম, দেখতাম, জানতাম কিন্তু সাথে সাথে সেই জামাটা কীভাবে পাওয়া যায়, কীভাবে মেকওভার করলে, আমাকে ওরকম ডল্ড আপ লাগবে সেটা একবারও ভাবতাম না।
আমাদের সময়কার পার্থক্য ছিল আমরা সেলুলয়েডের জীবনের সাথে আমাদের জীবনগুলোকে মিলিয়ে ফেলতাম না। শুধুমাত্র সানস্ক্রিন, লোশন, পাউডার, লিপ্সটিক আর কাজলের যুগে তখন সেটিং স্প্রে, ফাউন্ডেশন, হাজার শেডের লিপ্সটিক, প্রাইমার,হাইলাইটার, কন্সিলার এসবের বহুল প্রচলন না থাকাটা আমাদেরকে সাধারণ জীবন আর রূপালি পর্দার জীবনের পার্থক্য বুঝতে দিত খুব সুন্দরভাবে। এক জামা, এক শাড়ি শুধু নায়িকারা-ই একবার পরেন, সাধারণ মানুষ না – এটুকুও আমরা খুব সহজেই বুঝতাম। আমাদের ভালবাসা ছিল শাহরুখ, সালমান, ঐশ্বরিয়া, কাজলেরা আর আইডল ছিল ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া আপু বা ভাইয়াটা। ইদানিং চারপাশে দেখি কিন্তু কেন যেন কোনভাবেই সেইসময়কার সেই বয়সের জীবনের সাথে আজকের সেই একই বয়সের ছেলেমেয়ের জীবনকে আমি মেলাতে পারিনা। মাঝে মাঝে তাই মনে হয় সত্যিই কি ক্ষ্যাত-টাই না ছিলাম আমরা। তাইনা??
ডা. সাদিয়া ফাতেমা কবীর